আদুভাই
__আবুল মনসুর আহমদ
তিন
সেদিন বড়দিনের ছুটি আরম্ভ। শুধু হাজিরা লিখেই স্কুল ছুটি দেওয়া হল।
আমি বাইরে এসে দেখলাম : স্কুলের গেটের সামনে একটি পোস্তার উপর একটি উঁচু টুল চেপে তার উপর দাঁড়িয়ে আদুভাই হাত-পা নেড়ে বক্তৃতা করছেন। ছাত্ররা ভিড় করে তার বক্তৃতা শুনছে এবং মাঝে মাঝে করতালি দিচেছ।
আমি শ্রোতা মণ্ডলীর ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়লাম।
আদুভাই বলছিলেন : হাঁ, প্রমোশন আমি মুখফুটে কখনো চাইনি। কিন্তু সেজন্যই কি আমাকে প্রমোশন না-দেওয়া এঁদের উচিত হয়েছে? মুখফুটে না চেয়ে এতদিন আমি এঁদের আক্কেল পরীক্ষা করলাম। এঁদের মধ্যে দানাই বলে কোনো জিনিস আছে কিনা, আমি তা যাচাই করলাম। দেখলাম, বিবেচনা বলে কোনো জিনিস এঁদের মধ্যে নেই। এঁরা নির্মম, হৃদয়হীন। একটি মানুষ যে চোখ বুজে এঁদের বিবেচনার উপর নিজের জীবন ছেড়ে দিয়ে বসে আছে, এঁদের প্রাণ বলে কোনো জিনিস থাকলে সেকথা কি এঁরা এতদিন ভুলে থাকতে পারতেন?
আদুভাইয়ের চোখ ছলছল করে উঠল। তিনি বাম হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে আবার বলতে লাগলেন : আমি এঁদের কাছে কী আর বিশেষ চেয়েছিলাম? শুধুমাত্র একটি প্রমোশন। তা দিলে এঁদের কী এমন লোকসান হত? মনে করবেন না, প্রমোশন না-দেওয়ায় আমি রেগে গেছি। রাগ আমি করিনি। আমি শুধু ভাবছি, যাঁদের বুদ্ধি বিবেচনার উপর হাজার হাজার ছেলের বাপ-মা ছেলেদের জীবনের ভার দিয়ে নিশ্চিত থাকেন, তাঁদের আক্কেল কত কম। তাদের প্রাণের পরিসর কত অল্প!
একটু দম নিয়ে আদুভাই আরম্ভ করলেন: আমি বহুকাল এই স্কুলে পড়ছি। একদিন এক পয়সা মাইনে কম দেইনি। বছর-বছর নতুন-নতুন পুস্তক ও খাতা কিনতে আপত্তি করিনি। ভাবুন, আমার কতগুলো টাকা গিয়েছে। আমি যদি প্রমোশনের এতই অযোগ্য ছিলাম, তবে এই দীর্ঘদিনের মধ্যে একজন শিক্ষকও আমায় কেন বললেন না: ‘আদুমিঞা, তোমার প্রমোশনের কোনো চান্স নেই, তোমার মাইনেটা আমরা নেব না।’ মাইনে দেবার সময় কেউ বারণ করলেন না, পুস্তক কেনবার সময় কেউ নিষেধ করলেন না। শুধু প্রমোশনের বেলাতেই তাদের যত নিয়মকানুন এসে বঁধল? আমি ক্লাস সেভেন পাস করতে পারলাম না বলে ক্লাস এইটেও পাস করতে পারতাম না, এই কথা এঁদের কে বলেছে? অনেকে ম্যাট্টিক-আইএ-তে কোনোমতে পাস করে বিএ এমএ-তে ফার্স্টক্লাস পেয়েছে, দৃষ্টান্ত আমি অনেক দেখাতে পারি। কোনো কুগ্রহের ফেরেই আমি ক্লাস সেভেনে আটকে পড়েছি। একবার কোনোমতে এই ক্লাসটা ডিঙোতে পারলেই আমি ভালো করতে পারতাম, এটা বুঝা মাস্টারবাবুদের উচিত ছিল। আমাকে একবার ক্লাস এইটে প্রমোশন দিয়ে আমার লাইফের একটা চান্স এঁরা দিলেন না!
আদুভাইয়ের কণ্ঠরোধ হয়ে এল। তিনি খানিক থেমে ধুতির খুঁটে নাক-চোখ মুছে নিলেন। দেখলাম, শ্রোতৃগণের অনেকের গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
গলা পরিষ্কার করে আদুভাই আবার শুরু করলেন : আমি কখনো এতসব কথা বলিনি, আজো বলতাম না। বললাম শুধু এইজন্য যে, আমার বড়ছেলে এবার ক্লাস সেভেনে প্রমোশন পেয়েছে। সে-ও এই স্কুলেই পড়ত। এই স্কুলের শিক্ষকদের বিবেচনায় আমার আস্থা নেই বলেই আমি গতবারই আমার ছেলেকে অন্য স্কুলে ট্রান্সফার করে দিয়েছিলাম। যথাসময়ে এই সতর্কতা অবলম্বন না করলে, আজ আমাকে কী অপমানের মুখে পড়তে হত, তা আপনারাই বিচার করুন।
আদুভাইয়ের শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। তিনি গলায় দৃঢ়তা এনে আবার বলতে শুরু করলেন : কিন্তু আমি সত্যকে জয়যুক্ত করবই। আমি একদিন ক্লাস এইটে •••
এই সময় স্কুলের দারোয়ান এসে সভা ভেঙে দিল। আমি আদুভাইয়ের দৃষ্টি এড়িয়ে চুপেচুপে সরে পড়লাম।
তারপর যেমন হয়ে থাকে-সংসার-সাগরের প্রবল স্রোতে কে কোথায় ভেসে গেলাম, কেউ জানলাম না
চার
আমি সেবার বিএ পরীক্ষা দেব। খুব মন দিয়ে পড়ছিলাম। হঠাৎ লাল লেফাফার এক পত্র পেলাম। কারো বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র হবে মনে করে খুললাম। ঝরঝরে তকতকে সোনালি হরফে ছাপা পত্র। পত্ৰলেখক আদুভাই। তিনি লিখেছেন : তিনি সেবার ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস এইটে প্রমোশন পেয়েছেন বলে বন্ধুবান্ধবদের জন্য কিছু ডালভাতের ব্যবস্থা করেছেন।
দেখলাম, তারিখ অনেক আগেই চলে গিয়েছে। বাড়ি ঘুরে এসেছে বলে পত্র দেরিতে পেয়েছি। ছাপচিঠির সঙ্গে হাতের লেখা একটি পত্র। আদুভাইর পুত্র লিখেছে : বাবার খুব অসুখ, আপনাকে দেখবেন তার শেষ সাধ।
পড়াশোনা ফেলে ছুটে গেলাম আদুভাইকে দেখতে। এই চারবছর তাঁর কোনো খবর নিইনি বলে লজ্জা-অনুতাপে ছোট হয়ে যাচ্ছিলাম।
ছেলে কেঁদে বলল : বাবা মারা গিয়েছেন। প্রমোশনের জন্য তিনি এবার দিনরাত এমন পড়াশোনা শুরু করেছিলেন যে, শয্যা নিলেন তবু পড়া ছাড়লেন না। আমরা সবাই তার জীবন সম্বন্ধে ভয় পেলাম । পাড়াসুদ্ধ লোক গিয়ে হেডমাস্টারকে ধরায় তিনি স্বয়ং এসে বাবাকে প্রমোশনের আশ্বাস দিলেন। বাবা অসুখ নিয়েই পালকি চড়ে স্কুলে গিয়ে শুয়ে-শুয়ে পরীক্ষা দিলেন। আগের কথামতো তাকে প্রমোশন দেওয়া হল। তিনি তাঁর ‘প্রমোশন উৎসব উদযাপন করবার জন্য আমাকে হুকুম দিলেন। কাকে-কাকে নিমন্ত্রণ করতে হবে, তার লিস্টও তিনি নিজহাতে করে দিলেন। কিন্তু সেই উৎসবে যারা যোগ দিতে এলেন, তাঁরা সবাই তার জানাজা পড়ে বাড়ি ফিরলেন।
আমি চোখের পানি মুছে কবরের কাছে যেতে চাইলাম।
ছেলে আমাকে গোরস্তানে নিয়ে গেল। দেখলাম, আদুভাইয়ের কবরে খোদাই-করা মার্বেলপাথরের ট্যাবলেটে লেখা রয়েছে :
Here sleeps Adu Mia who was promoted from Class VII to Class VIII.
ছেলে বলল : বাবার শেষ ইচ্ছামতোই ও-ব্যবস্থা করা হয়েছে।